
জমিদারবিহীন কালের সাক্ষ্যী মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ
রূপগঞ্জের রূপের নেইকো শেষ, অপরূপ রূপের প্রসরা সাজিয়ে বসে আছে রূপগঞ্জের কালের সাক্ষ্যী মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি। এককালে পাইক পেয়াদার পদচারনায় মূখরিত ছিল যে বাড়িটি আাজ তা প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি শুধু। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি। পাখি ডাকা ছায়া সু- নিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়িটি দেখতে কার না মন কাড়ে।
১২০০ বঙ্গাব্দে এসে প্রজাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার-নিপিড়ন,ক্ষমতার অপব্যবহার। সুন্দরী মেয়ে, ঘরের বধূ, এদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়লে রেহাই পেতো না। ধীরে ধীরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। আর আজো সেসব রসময় কাহিনী অত্যাচার নির্যাতন প্রভাবের গল্প গ্রামাঞ্চলে কল্পকাহিনীর মতো ছড়িয়ে আছে। জমিদারি প্রথার শেষ দিকে নানাভাবে বিদ্রোহের পটভুমি তারই অংশ। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। ফলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর প্রতাপশালী সেই রাজবাড়িটি শুন্য হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। তৎকালীন সরকার এখানে একটি হাসপাতাল স্থাপন করে। কিছুকাল এটি কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পরে ১৯৬৬ সালে এখানে হাইস্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি মুড়াপাড়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি সারা দেশের ভ্রমণপ্রিয় বা ইতিহাসবিদদের কাছে এক দারুণ আকর্ষণের নাম। বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও শতবর্ষী জমিদার বাড়ি এটি। বিভিন্ন সময় এই ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি কয়েকজন জমিদার কর্তৃক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। এর গোড়পত্তন করেন বাবু রামরতন ব্যানার্জি। এরপর তার কয়েকজন বংশধর কর্তৃক প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে, রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের ইতিহাস, কৃষ্টি, সভ্যতা ও এখানকার জনবসতি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জি এই ভবনের পেছনের অংশ সম্প্রসারণ করেন ও পরিবার নিয়ে এখানেই বসবাস শুরু করেন। তার ছেলে বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জি ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাসাদের সামনের অংশে একটি ভবন নির্মাণ ও দুটি পুকুর খনন করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় চন্দ্রের দুই ছেলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জি কর্তৃক প্রাসাদের দোতালার কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৪৭ খিষ্ট্রাব্দে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর জগদীশ চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে কলকাতা গমন করেন। এরপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি দখল নেয় এবং এখানে হাসপাতাল ও কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির দায়িত্ব গ্রহণ করে সেটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া এলাকায় ৫২ বিঘা জমির ওপর এই প্রকা- জমিদার বাড়ি অবস্থিত। ১৭৬ বছর আগে নির্মিত বিশাল দোতলা এ জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে মোট ৯৫টি কক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে শোয়ার ঘর, দরবার হল, নাচঘর, আস্তাবল, উপাসনালয়, ভা-ার, কাচারি ঘরসহ সবই। বিশালাকৃতির প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হয় ভেতরে। অন্দর মহলে রয়েছে আরও ২টি ফটক। সর্বশেষ ফটক পেরিয়ে মেয়েদের গোসলের জন্য ছিল শানবাঁধা পুকুর। পুকুরের চারধার উঁচু দেয়ালে ঘেরা। এখানে প্রবেশ বাইরের লোকদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাড়ির সামনে রয়েছে আরও একটি বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারদিক নকশি কাটা ঢালাই লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা, চারদিকে চারটি শানবাঁধানো ঘাট। মূলত, এ পুকুরটি তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধন এবং পুরুষ মেহমানদের গোসলের জন্যই। ভবনের সামনের পুকুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- পানি কম-বেশি হওয়ার ব্যাপারটি ছিল শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, কারণ এই পুকুর মাটির নিচ দিয়ে নদীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
পুকুরসংলগ্ন মন্দিরে বড় দুটি চূড়া রয়েছে। তা প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। এর প্রবেশ দ্বারগুলো খিলান দিয়ে নির্মিত। মন্দিরের মূল কক্ষ বেশ ছোট এবং অন্ধকার। মন্দিরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে ছায়াঘেরা শান্ত-শ্যামল আম্রকানন। গাছগুলো বেশ পুরোনো। একই মাপের ঝাঁকড়ানো গাছ। ডালপালা ছড়ানো, অনেকটা ছাতার মতো। অসংখ্য গাছ। প্রায় প্রতিটি আমগাছের গোড়া পাকা করা। এ ছাড়া জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই রয়েছে সারি সারি ঝাউগাছ।
পাখি ডাকা ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়িটির ভবনগুলোর নির্মাণশৈলী ও কারুকাজ রুচিসম্মত পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। সে আকর্ষণ থেকেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসেন সুবিশাল বাড়িটি দেখতে। ঢাকা থেকে এ জমিদার বাড়িটি আসতে সময় লাগে মাত্র ৩০-৪০ মিনিট। বাসে কিংবা সিএনজি, প্রাইভেট কারে করে আসতে পারেন এখানে। রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ, গুলিস্তান অথবা যাত্রাবাড়ী থেকে যেকোনো পরিবহনে রূপগঞ্জের রূপসী বাসস্ট্যান্ড কিংবা ভুলতা পর্যন্ত এসে সেখান থেকে সিএনজি অথবা রিকশাযোগে সহজেই আসা যায় এ জমিদার বাড়িতে। এ ছাড়া রাজধানীর ডেমরাঘাট হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে মাঝিনা ঘাট থেকে নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হলেই রূপগঞ্জের জমিদার বাড়ি। আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেই চিন্তার কিছু নেই। জমিদার বাড়ির কাছেই মুড়াপাড়া বাজার। ওখানে গিয়ে হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে অনায়াসেই।
মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি ঘুরতে যেতে পারেন যে কোনো দিনই। তবে ছুটির দিনে এলে ভালো হয়, তাতে কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণে যেমন ব্যাঘাত ঘটবে না, তেমনি নিজেও পরিপূর্ণভাবে ঘুরে দেখতে পারবেন জমিদার বাড়িটি। সঙ্গে শিশুরা থাকলে তারাও কলেজের বিশাল সবুজ মাঠে খেলাধুলাও করতে পারবে মনের আনন্দে।####